দেশব্যাপী যখন পুলিশের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে জনসাধারণের আস্থা ও ভরসা অর্জনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে তখনও থেমে নেই পাবনার ঈশ্বরদীস্থ রূপপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশের এসআই কান্তি কুমার মোদকের চাঁদাবাজি, সাজানো মাদক মামলা দেওয়া, গ্রেফতার বাণিজ্যসহ অপরাধমুলক নানা কর্মকান্ড।
এসব ঘটনার ধারাবাহিতকায় এবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোয়ারা দিতে অস্বীকার করায় মার্কেট মালিকসহ ব্যবসায়ীদের মাদক মামলা দিয়ে গ্রেফতারসহ নানা রকম হুমকি ধামকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আর এ ঘটনার প্রতিবাদে ও শাস্তির দাবীতে গত ২১ আগষ্ট/২৪ পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সংলগ্ন মোড়ের দোকান মালিক রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত ট্রেন চালক (এলএম) মো.সায়দাৎ হোসেনসহ ৩৯ জন ব্যবসায়ী গণ স্বাক্ষর করে পাবনা পুলিশ সুপারের নিকট অভিযোগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে পাবনা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বরাবর অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগিদের দেওয়া অভিযোগ সুত্রে জানা যায়, রূপপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কান্তি কুমার মোদককে হয় মাসোয়ারা দিতে হবে, নয় মাদক মামলাসহ নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হবে। আর তার চাহিদাকৃত টাকা দিলেই মাদকসহ গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অথবা উদ্ধারকৃত মাদকের পরিমান কম দেখিয়ে কিংবা অন্য ধারায় কোর্টে প্রেরণ করা হয়। বাল্য বিয়ের খবরে মামলার ভয় দেখিয়ে নেওয়া হয় টাকা।
টাকা দিলে এমন কোন কাজ নাই যা হয় না পাবনার ঈশ্বরদীস্থ রূপপুর পুলিশ ফাঁড়িতে। আর প্রতিপক্ষের সঙ্গে আর্থিক চুক্তিতে মাদক দিয়ে ফাঁসানোটা তো এখন দৈনন্দিনের সাধারণ ঘটনা। এসব ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছেন ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশের এসআই কান্তি কুমার মোদক।
তবে কান্তি কুমার মোদকের এসব অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম ও হয়রানির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগিদের পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার পুলিশ হেডকোয়াটার, ডিআইজি, পাবনা পুলিশ সুপার, ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নিকট বিচার চেয়ে অভিযোগ করা হলেও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতে দেখা যায়নি। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে অন্যায়, চাঁদাবাজি, গ্রেফতার বাণিজ্য, সাজানো মামলা দেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েই চলেছে কান্তি কুমার মোদক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২ সেপ্টেম্বর/২৩ সন্ধ্যায় ঈশ্বরদী থানাধীন বাঁশেরবাদা খয়েরদারী ব্রীজের পাশ থেকে মো. রইজ উদ্দিনের ছেলে ক্যাসিনো অনলাইন জুয়ার প্রধান পরিচালনাকারী মো. আল আমিন (২৮), একই উপজেলার দাশুড়িয়ার বয়রা গ্রামের মজিবার রহমানের ছেলে জীম আলী (১৯), ইসারত আলীর ছেলে লিজন আহম্মেদ (১৮) ও পাবনার দাপুনিয়া ঘোষপাড়া মির্জাপুরের জালাল উদ্দিন আকন্দের ছেলে সাকিব হোসেনকে (২২) দুই কেজি গাঁজাসহ আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন কান্তি কুমার মোদক।
জুয়া পরিচালনাকারী আল আমিনের মোবাইলের বিকাশ একাউন্টে থাকা ৮৫০ ইউএস ডলার (বাংলাদেশী টাকা আনুমানিক এক লাখ আট হাজার ৮০০ টাকা) বের করে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের পরিবারের নিকট থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে মাদক মামলা না দিয়ে ১৫১ ধারায় কোর্টে চালান দেওয়া হয়। আর গাঁজা অন্যত্র বিক্রয় করে মোট দুই লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ টাকা গ্রহন করেন এসআই কান্তি।
গত ২১ মার্চ/২৪ রুপপুর বিবিসি বাজার এলাকার কোরবান আলীর ছেলে ভ্যান চালক সেলিম হোসেন প্লাস্টিকের পাইপ বোঝাই করে যাওয়ার সময় তাকে অহেতুক আটকিয়ে ৫ হাজার টাকা গ্রহন করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত ৭ এপ্রিল/২৪ দুপুরে এক পুরিয়া গাঁজাসহ ঈশ্বরদীর মধ্য অরণকোলা এলাকার হাশেম মন্ডলের ছেলে ভ্যান চালক মুকুল হোসেনকে আটক করে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত ৬ এপ্রিল/২৪ পাকশী বিবিসি বাজার এলাকার মামুন হোসেনের মেয়ে স্মৃতি খাতুনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে একই এলাকার নাজমুল হোসেনের ছেলে ইমন হোসেন পালিয়ে বিয়ে করে। বিষয়টি জানতে পেরে কান্তি কুমার মোদক ওই ছেলের বাবা-মাকে নানা রকম হুমকি ধামকি দিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেন।
গত ২১ এপ্রিল/২৪ রাতে ফেইসবুকে প্রেমের জেরে উপজেলার দিয়াড় সাহাপুর গ্রামের বাদশা ফকিরের ছেলে কাওছার হোসেনকে ধরে এনে ৩০ হাজার টাকা আদায় করেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর/২৩ রাতে উপজেলার আওতাপাড়া গ্রামের মৃত রজব আলীর ছেলে সিএনজি চালক খায়রুল ইসলামকে এক কেজি গাঁজাসহ রূপপুর মোড় থেকে আটক করা হয়। তার পরিবারের নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। আর এক কেজির পরিবর্তে ৩০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার মামলায় চালান করে এসআই কান্তি কুমার মোদক।
২০ এপ্রিল/২৪ পাবনার মাধপুর এলাকার নুর মোহাম্মাদের ছেলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের রইনওয়ার্ল্ড কম্পানির সুপারভাইজার কামরুল ইসলাম মেরামতের জন্য মেকারের দোকানে তার মোটর সাইকেলটি রেখে যান। সেই মোটর সাইকেল থেকে হেরোইন ও ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে প্রকল্প থেকে তাকে ডেকে এনে গ্রেফতার করা হয়। তার পরিবারের নিকট থেকে নেওয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। আর কামরুলকে আটক করতে প্রতিপক্ষের নিকট থেকে কান্তি কুমার মোদক নেন দুই লাখ টাকা।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আবর্জনার সঙ্গে পাচার হওয়া লোহার মালামাল, মুল্যবান তামার ক্যাবলসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রয় চক্র, রূপপুর মোড়ের দোকানদার, ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা, সিএনজিসহ সকল ধরণের কাগজপত্র বিহীন যানবাহন চালক সমিতির নিকট থেকে মাসিক চুক্তিতে মাসোয়ারা আদায় করছেন ফাঁড়ি ইনচার্জ কান্তি কুমার মোদক।
রূপপুর মোড়ের দোকানদাররা অভিযোগ করে জানান, রূপপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ কান্তি কুমার মোদক দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিকট থেকে মাসোয়ারা নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এবার মাসোয়ারা দিতে রাজি না হওয়ায় দোকানমালিকসহ তাদেরকে মাদক মামলায় ফাঁসানো, দোকান গুড়িয়ে দেওয়াসহ অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও হুমকি দিয়েছেন। এইজন্য তার শাস্তির দাবীতে গণ স্বাক্ষর করে পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
রূপপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই কান্তি কুমার মোদক সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, বদলী হয়ে যাচ্ছি। যা ইচ্ছে তাই লেখেন। অসুবিধা নেই। এসব বিষয়ে জানতে গত দুইদিন ধরে পাবনা পুলিশ সুপার মো. মোরতোজা আলী খানের ব্যবহৃত সরকারী নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে এব্যাপারে ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার গোস্বামী জানান, রূপপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই কান্তি কুমার মোদকের অপরাধের ভার পুলিশ বাহিনী নিবে না। কারণ পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগিরা পাবনা পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগ করেছে। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসবে সেই নির্দেশ অনুসারে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।